তারাবির নামাজের নিয়ম, দোয়া, রাকাত সংখ্যা ও মোনাজাত
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ২০২৪ এর রমজান শুরু হবে। মুসলমানদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং ফজিলতপূর্ণ এই মাসে তারাবির নামাজের নিয়ম জানাটাও প্রয়োজনীয়। এই নামাজ নিয়ে অনেকেই জানতে চাই এবং বিভিন্ন মতানৈক্য রয়েছে তার মাঝে কোনটা সঠিক এটা সম্পর্কে বিভ্রান্তি না হয়ে আজকের নিবন্ধটি পড়ুন।
মূলত নবীর যুগে তারাবি কেমন ছিল ঠিক সেই ভাবে আদায় করব ইনশাআল্লাহ। যেহেতু আমরা রাসুল সাঃ কে অনুসরণ করি তাই আমরা তার মতনই তারাবি পড়বো। তারাবির নামাজের নিয়ম কানুন মহিলাদের জন্য সেটাও আজকে আলোচনা করা হবে।
তারাবির নামাজের নিয়ম-কানুন খুবই সহজ। এটি সাধারণ নফল নামাজের মতোই পড়া হয়, তারাবির নামাজের নিয়ত করে। তবে, তারাবির নামাজে প্রতি রাকাতে সালাম ফিরে কিছুক্ষণ বসে থাকার নিয়ম রয়েছে। তারাবির নামাজের সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে দেয়া হল:
- তারাবির নিয়ত: আমি কেবলামুখী হয়ে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেছি যেটা সুন্নত।
- তারাবির নিয়ম: এশার ফরজ এবং দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদার পরে দুই দুই রাকাত করে মোট ২০ রাকাত আদায় করবে।
- রাকাত সংখ্যা: চার ইমামের প্রত্যেকের মতে তারাবি ২০ রাকাত এবং এটাই গ্রহণযোগ্য এবং নবী (সাঃ) এর যুগেও এরকম ছিল।
- দোয়া: taraweeh namaz এর প্রত্যেক চার রাকাত পর পর বিশ্রাম নেয়া হয় এতে যেকোনো দোয়া, যিকির-আযকার এবং নিরবে কোরআন শরীফ পড়া যায়।
- সুন্নত না নফল: রমজান মাসে ইশা এবং দুই রাকাত সুন্নতের পর ২০ রাকাত তারাবি সুন্নতে মুয়াক্কাদা।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজানে তারাবির নামাজ আদায় করেন, তার অতীতের গুনাহগুলো আল্লাহপাক ক্ষমা করে দেবেন।
বুখারী শরীফ
তারাবির নামাজ পড়ার নিয়ম
এশারের ফরজ নামাজ এবং দুই রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা পড়ে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ দুই দুই রাকাত করে পড়তে হয়। প্রতি চার রাকাতের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া মুস্তাহাব। এই নামাজে সুরা ফাতেহার সাথে যে কোন সূরা মিলানো যায়।
পুরো রমজানের মধ্যে একবার কোরআন শরীফ শ্রবণ করা বা পড়া একটি মুস্তকিল সুন্নত। কোরআন শরীফ শুনাটা ইমাম সাহেবের দ্বারা জরুরি নয়, ইমাম ব্যতীত অন্য কেউ হলেও যথেষ্ট।
আমাদের দেশে সাধারণত দুইভাবে তারাবি নামাজ পড়তে দেখা যায় ১. সূরা তারাবি ২. খতম তারাবি। সূরা তারাবি বলতে সুরা ফাতেহার পরে যে কোন সূরা পড়া। আর খতম তারাবি বলতে সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ এক বা একাধিক খতম করা।
তারাবির নামাজের নিয়ত
তারাবি নামাজের জন্য ‘আমি ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেছি যেটা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ’ বলে বাংলায় এভাবেই নিয়ত করলে হয়ে যাবে। তবে, প্রতি দুই রাকাতের জন্য একবার করে নিয়ত করা ভালো, এক্ষেত্রে ২০ রাকাতের জায়গায় ২ রাকাত বলবে।
আরবি নিয়ত – নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা, রাকাআতাই সালাতিত তারাবিহ সুন্নাতে রাসূলিল্লাহি তায়ালা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতি শারিফাতি, আল্লাহু আকবার।
তারাবীহ নামায সুন্নতে মুয়াক্কাদা, যার অর্থ এটি পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদা নামাযের মতই এর নিজস্ব নিয়ত রয়েছে। তবে, সাধারণ নামাযের নিয়ত দিয়েও তারাবি নামাজের নিয়ত করা যায়, তবে বিশেষভাবে “তারাবীহ” উল্লেখ করা আবশ্যক।
তারাবির নামাজের দোয়া
তারাবির নামাজ অন্যান্য নামাজের থেকে একটু লম্বা হয় তাই এতে প্রতি চার রাকাত পর পর বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ রয়েছে। এই বিশ্রাম কালে, নির্দিষ্ট কোন দোয়া, জিকির এবং নামাজ পড়ার কথা কোরআন-হাদিসে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তবে আমরা নিচের দোয়াটি পড়তে পারি:
سُبْحانَ ذِي الْمُلْكِ وَالْمَلَكُوتِ سُبْحانَ ذِي الْعِزَّةِ وَالْعَظْمَةِ وَالْهَيْبَةِ وَالْقُدْرَةِ وَالْكِبْرِيَاءِ وَالْجَبَرُوْتِ سُبْحَانَ الْمَلِكِ الْحَيِّ الَّذِيْ لَا يَنَامُ وَلَا يَمُوْتُ اَبَدًا اَبَدَ سُبُّوْحٌ قُدُّوْسٌ رَبُّنا وَرَبُّ المْلائِكَةِ وَالرُّوْحِ
বাংলা উচ্চারণ : ‘সুবহানা জিল মুলকি ওয়াল মালাকুতি, সুবহানা জিল ইয্যাতি ওয়াল আঝমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিব্রিয়ায়ি ওয়াল ঝাবারুতি। সুবহানাল মালিকিল হাইয়্যিল্লাজি লা ইয়ানামু ওয়া লা ইয়ামুত আবাদান আবাদ; সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রাব্বুনা ওয়া রাব্বুল মালায়িকাতি ওয়ার রূহ।’
মনে রাখবেন, প্রতি ৪ রাকাত পর পর বিশ্রাম অবস্থায় নিম্নস্বরে কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ, দোয়া ও জিকির এবং একা একা নফল নামাজ পড়তে পারবে। অথবা চাইলে কেউ চুপ থাকতে পারে বা বিশ্রাম নিতে পারে। দোয়া নিয়ে বিস্তারিত।
তারাবির নামাজ কত রাকাত
তারাবির নামাজ ২০ রাকাত যদিওবা এ নিয়ে বিভিন্ন মতানৈক্য দেখা দেয়। তারপরেও সবচাইতে সঠিক এবং শুদ্ধ হচ্ছে ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়া। বিশেষ করে এই রাকাত সংখ্যা আবু বকর (রাঃ) এর জামানা থেকে শুরু করে খেলাফতে রাশেদার জামানায় ২০ রাকাত পড়া হত।
তা ছাড়া, বর্তমান সময়েও মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী, এমনকি পূর্ব-পশ্চিম সবখানেই এর উপরে আমল করা হয়। তাই এর অস্বীকার করা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। যারা ৮ রাকাত বলে, তারা যে হাদীসটি দলিল হিসেবে সাব্যস্ত করে, সেটা মূলত রাসূল সাঃ এর তাহাজ্জুদের হাদিস।
তারাবির রাকাত সম্পর্কিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চার ইমাম – ইমাম আবু হানিফা, মালেক, শাফেয়ী এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল – সকলেই ২০ রাকাত তারাবি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। তাই এটিই সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য এবং আমলনীয় কাজ।
তারাবির নামাজের মোনাজাত
اَللَهُمَّ اِنَّا نَسْئَالُكَ الْجَنَّةَ وَ نَعُوْذُبِكَ مِنَ النَّارِ يَا خَالِقَ الْجَنَّةَ وَالنَّارِ- بِرَحْمَتِكَ يَاعَزِيْزُ يَا غَفَّارُ يَا كَرِيْمُ يَا سَتَّارُ يَا رَحِيْمُ يَاجَبَّارُ يَاخَالِقُ يَابَارُّ اَللَّهُمَّ اَجِرْنَا مِنَ النَّارِ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ يَا مُجِيْرُ- بِرَحْمَتِكَ يَا اَرْحَمَ الرَّحِمِيْنَ
মোনাজাত উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউজুবিকা মিনাননার। ইয়া খালিক্বাল জান্নাতি ওয়ান নার। বিরাহমাতিকা ইয়া আঝিঝু ইয়া গাফফার, ইয়া কারিমু ইয়া সাত্তার, ইয়া রাহিমু ইয়া ঝাব্বার, ইয়া খালিকু ইয়া বার্রু। আল্লাহুম্মা আঝিরনা মিনান নার। ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝিরু, ইয়া মুঝির। বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।’
মোনাজাতের উদ্দেশ্য হলো নিজের প্রয়োজনের কথা বা উদ্দেশ্য আল্লাহতালার কাছে তুলে ধরা। তবে এমন নয় যে তারাবির মোনাজাত করা অত্যাবশ্যক। এখানে আপনি যেকোনো ধরনের দোয়া পড়তে পারেন যা আপনি প্রয়োজন মনে করেন।
উপরে যে দোয়াটি রয়েছে সেটি বহুল প্রচলিত এবং পরিচিত, তাই এটি শেয়ার করলাম। এই দোয়াটি পড়ার পাশাপাশি আপনি আপনার অন্যান্য দোয়াও পড়তে পারেন তারাবির মোনাজাতে।
তবে মনে রাখবেন, কেউ যদি মনে করে যে তারাবির নামাজ বা অন্য যেকোনো নামাজের পরে হাত তুলে মুনাজাত করা অত্যাবশ্যক, তাহলে সেটি গুনাহ হবে। এই ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, মোনাজাত করা ফরজ নয়, বরং মুস্তাহাব।
তারাবির নামাজ সুন্নত নাকি নফল
২০ রাকাত তারাবির নামাজ সুন্নাতে মু’আক্কাদাহ। এর অর্থ হলো, এটি নবী করিম (সাঃ) এর সুস্পষ্ট আমল, যা তাঁর পরবর্তী সাহাবাগণ (রাঃ), তাবেঈন, এবং মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশের দ্বারা দীর্ঘকাল ধরে অনুসরণ করা হয়ে আসছে।
এই জন্য আমরা তারাবির নিয়ত করার সময় সুন্নত শব্দটি উল্লেখ করবো, সেই সাথে তারাবি শব্দটাও উল্লেখ করা আবশ্যক। আর অবশ্যই মনে রাখবেন পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্য তারাবির নামাজ সুন্নাতে মু’আক্কাদাহ।
তারাবি নামাজের নিয়ত কিভাবে করতে হয়?
নিয়ত মানে মনের ইচ্ছা, তাই আমরা তারাবির ক্ষেত্রে বলবো ২০ রাকাত তারাবির নামাজ আদায় করতেছি। এই বলেই নিয়ত করলে তারাবির নিয়ত হয়ে যাবে।
তারাবির নামাজের দোয়া কতবার পড়তে হবে?
তারাবি নামাজের দোয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা নেই যে কতবার পড়তে হবে। তবে, যার যত ইচ্ছে যে কোন দোয়া এবং জিকির-আযকার ইত্যাদি করতে পারে।
তারাবির নামাজের সময় কখন?
তারাবির নামাজের সময় ইশার নামাজের পর থেকে শুরু হয় এবং সুবহে সাদিক পর্যন্ত স্থায়ী হয়। সুতরাং, যদি কেউ সুবহে সাদিকের পূর্বে তারাবির নামাজ আদায় করে, তাহলে তার নামাজ আদায় হয়ে যাবে।
তবে, তারাবির নামাজের উত্তম সময় হলো ইশার নামাজের পর থেকে রাতের প্রথম ভাগ। কারণ, এই সময়ে নামাজ আদায় সুন্নাহ সম্মত।
শেষ কথা
আজকের এই আর্টিকালি আমি যথাসম্ভব তারাবির নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত বলার চেষ্টা করেছি। আশা করি এই আর্টিকেলটি আপনাদের উপকারে এসেছে, এবং আপনার বন্ধুবান্ধবদের সাথে শেয়ার করতে পারেন যেন তারাও জানতে পারে।