তওবা নামাজের নিয়ম [দোয়া, অর্থ, নিয়ত, শর্ত, রাকাত]

মানুষ বলতেও ভুল, ভুল বলে আপনি কি গুনাহ করে ভুলের মধ্যেই থেকে যাবেন? নাকি তওবার নামাজের নিয়ম জেনে এবং তওবার দোয়া সম্পর্কে জেনে পুনরায় আল্লাহর কাছে ফিরে আসবেন। গুনাহ হওয়ার পরে আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা চাওয়ার জন্য যে নামাজ পড়া হয়, তাকেই তওবার নামাজ বলে।

দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেক গুনাহ করে ফেলি, গুনাহ করার পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চাওয়া আমাদের জন্য জরুরি। বিগত জীবনে আপনি যা ভুল করেছেন সেগুলো থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্যও তওবার নামাজ পড়া হয়ে থাকে।

বিজ্ঞ আলেমের মতে তওবার নামাজ পড়া মুস্তাহাব, কারণ বিভিন্ন হাদিস থেকে তওবার নামাজ সম্পর্কে বিভিন্ন ফজিলত পাওয়া যায় এবং সাহাবায়ে কেরাম তওবার নামাজ পড়েছেন। আমাদের উচিত যদি কখনো গুনাহ হয়ে যায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আল্লাহতালার কাছে তওবা করা।

সালাতুল তাসবিহ নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

তওবা করার অন্যতম একটা নিয়ম হলো নামাজ, উত্তমরুপে ওযু করে আমরা চাইলে নামাজ পড়ার মাধ্যমে, আল্লাহতালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি। আজকে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব অর্থাৎ তওবার নামাজের নিয়ম সম্পর্কে।

সালাতুত তাওবা

আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে ভালো ও মন্দ দুই প্রবণতাই সুপ্ত রেখেছেন। অতঃপর মানুষের জন্য ভালো ও মন্দ দুই পথ চিহ্নিত করে দিয়েছেন, যাতে মানুষ তার কর্মের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে- কে আল্লাহর সন্তুষ্টিকামী, আর কে প্রবৃত্তির অনুসারী।

নবীগণ ছাড়া অন্য সকল মানুষেরই কিছু না কিছু গুনাহ হয়ে যায়। তবে মুমিন এ কারণে হতাশ হয় না; বরং আপন কৃতকর্মের উপর অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করে এবং গুনাহ্র সিয়াহী থেকে পরিষ্কার হওয়ার চেষ্টা করে।

তাওবা অর্থ হল কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং আগামীতে না করার সংকল্প করা

কুরআন মজীদে এসেছে- আপনি আমার ওই বান্দাদের বলে দিন, যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছে, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল গোনাহ ক্ষমা করবেন। নিঃসন্দেহে তিনিই হলেন পরম ক্ষমাশীল, অতি দয়ালু। (সূরা যুমার: ৫৩)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে- ‘আমি অতি ক্ষমাশীল তার প্রতি, যে তাওবা করে, ঈমান আনে সৎকর্ম করেএবং সৎপথে অবিচলিত থাকে।’ (সূরা তহা: ৮২)

ইসলামে তাওবার পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। তাওবার জন্য কোনো মাধ্যম গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। খৃষ্টধর্মে যেমন রয়েছে- পাদ্রীর সম্মুখে পাপ স্বীকার করে ক্ষমাপত্রে দস্তখত করার আগ পর্যন্ত পাপের কালিমা থেকে মুক্ত হওয়া যায় না- এমন কোনো ধারণা ও নিয়ম ইসলামে নেই।

তাওবার উদ্দেশ্যে যদি দু’ রাকাআত নামায পড়া যায় তবে অতি উত্তম।

হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন- ‘যার কোনো গুনাহ হয়ে যায়, এরপর সে উত্তমরূপে অযু করে দু’ রাকাআত নামায পড়ে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই আয়াত পাঠ করেন- ‘আর যারা কোনো মন্দ কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের উপর জুলুম করে বসলে আল্লাহকে স্মরণ করে কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে আছে যে গুনাহসমূহ ক্ষমা করে। আর তারা তাদের কৃতকর্মের উপর জেনে শুনে অবিচল থাকে না।’ (হাদীসটি সুনানে আবু দাউদে (১: ২১২) বর্ণিত হয়েছে।’)

তওবার নামাজ কি

তওবা একটি আরবি শব্দ যার বাংলা অর্থ হচ্ছে অনুশোচনা করা, মহান আল্লাহ তাআলার কাছে ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করাকেই তওবা বলা হয়। মূলত তওবা শব্দটি কোরআন এবং হাদিসে বিভিন্ন জায়গায় এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার নিষেধকৃত বিষয়গুলো ত্যাগ করা এবং আদেশকৃত বিষয়গুলোর দিকে ফিরে আসা।

আমরা যে গুনাহগুলো করে থাকি সেগুলো পরিত্যাগ করে আল্লাহ তায়ালার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করাকে তওবা বলা হয়। যেহেতু আমরা যে গুনাহগুলো করে ফেলি বা কৃতকর্মের ক্ষমাপ্রার্থনার বিষয়ে কোরআন হাদিসে অনেক বার উল্লেখ হয়েছে, তাই তওবার অনেক গুরুত্ব এবং ফজিলত আছে।

তওবা নামাজের নিয়ম

তওবার নামাজের জন্য অন্যান্য নামাজের মত উত্তম রূপে ওযু করবে। তারপর দুই রাকাত সালাতুত তওবা পড়ার নিয়তে নিয়ত বাঁধবে। এভাবে আপনি দুই রাকাত নামাজ শেষ করে আপনার হয়ে যাওয়া পাপের ক্ষমা প্রার্থনা করবেন আল্লাহতালার কাছে।

তবে প্রথম রাকাতে সূরা ফাতিহা পড়ার পরে সূরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সূরা ফাতেহা পড়ার পরে সূরা ইখলাস পড়া উত্তম। কোথাও মন মানসিকতা না দিয়ে দুই রাকাত উত্তম রূপে নামাজ আদায় করার পর, আল্লাহ তাআলার কাছে কেঁদে কেঁদে আপনার কৃত পাপের ক্ষমাপ্রার্থনা করতে হবে।

আপনি যে গুনাহ গুলো করে ফেলেছেন সেগুলো তওবার নামাজ শেষ করে যখন আল্লাহতালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন, তখন গুনাহ গুলো মনে করে করে দিলের মধ্যে শরম/লজ্জা অনুভব, নিজেকে দোষারোপ এবং ভবিষ্যতে এই সমস্ত গুনাহ আর করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করবেন।

আপনার কাছে যদি কেও হক পেয়ে থাকে তাহলে সেটা আদায় করে দিতে হবে। কেননা যার হক তাকেই মাফ করতে হবে, আপনি আল্লাহ তাআলার যে হক নষ্ট করেছেন/গুনাহ করেছেন সেগুলো আল্লাহ তায়ালার কাছে চাইলে আল্লাহ তাআলা মাফ করে দিবেন, কিন্তু বান্দার হক আল্লাহ তায়ালা মাফ করবেন না।

গর্ভবতী মায়ের নামাজের নিয়ম

তাই অবশ্যই আপনার কাছে যদি কেউ কোন কিছু পেয়ে থাকে বা আপনি কারো হক নষ্ট করেন তাহলে তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবেন। আর অবশ্যই মনে মনে এটা এরাদা করতে হবে যে, ভবিষ্যতে আমি এই পাপ আর করব না এই বলে প্রতিজ্ঞা করা।

আল্লাহ তায়ালার নিকট তওবা করার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত-শরায়েত যেগুলো আপনাদের সুবিধার্থে স্টেপ বাই স্টেপ নিচে উল্লেখ করবো তাই আপনারা এই বিষয়গুলো জানতে নিচের লেখাগুলো পড়ে ফেলুন ভালোভাবে। না হলে তওবার নামাজের নিয়ম জানার পরেও শর্ত না মানলে হবে না।

তওবার নামাজের আরবি নিয়ত

نويت ان اصلي لله تعالى ركعتي صلاة التوبه سنة رسول الله تعالى متوجها الى جهة الكعبة الشريفة الله اكبر

তওবার নামাজের বাংলা নিয়ত

আমি কিবলামুখী হয়ে আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে দুই রাকাত সালাতুত তওবা আদায় করতেছি, এই বলে আল্লাহু আকবর বলে হাত বাঁধা।

তওবার শর্ত

মাঝে মাঝে আমাদের যে ভাবগুলো হয়ে যায় সেগুলো থেকে তওবা করা আমাদের কর্তব্য, ওয়াজিব বা জরুরী। তো এখন তওবা করতে কিছু নিয়মকানুন এবং শর্ত রয়েছে। সাধারণত আমরা দুই ধরনের হক নষ্ট করে থাকি ১. আল্লাহর হক ২. বান্দার হক, এই উভয় হক থেকে যদি আমরা নিজেকে নিষ্পাপ করতে চাই তাহলে অবশ্যই কিছু শর্ত রয়েছে। আল্লাহর হক নষ্ট করে যদি আপনি তওবা করতে চান তাহলে ৩ টি শর্ত রয়েছে

  1. আপনি যে পাপ থেকে তওবা করতে চান তা পুরোপুরি বর্জন করতে হবে
  2. আপনি যে পাপ করেছেন তার উপর লজ্জিত হতে হবে
  3. আপনি পাপটা আর ভবিষ্যতে করবেন না এর উপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করতে হবে

আর আপনি যে কাজটা করেছেন সেটা যদি মানুষের সাথে সম্পর্কিত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রেও আপনাকে কিছু শর্ত মানতে হবে। আর সেক্ষেত্রে রয়েছে ৪ টি শর্ত, সেখান থেকে উপরের ৩টি এবং আরেকটি হচ্ছে হকদারের হক ফিরিয়ে দেওয়া তথা অবৈধ পথে কারো হক নিয়ে থাকলে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া, কাহারো সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থাকলে তার কাছে তা পেশ করা এবং ক্ষমা চাওয়া বা শাস্তি গ্রহণ করা ইত্যাদি।

তওবার নামাজ কয় রাকাত

তওবার নামাজ দুই রাকাত কেননা হাদীসে এসেছে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘যে ব্যক্তি আমার মত এ রকম উযূ করবে, অতঃপর দু’রাক‘আত সালাত আদায় করবে, যাতে দুনিয়ার কোন খেয়াল করবে না, তার পূর্বের গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (১৬০, ১৬৪, ১৯৩৪, ৬৪৩৩; মুসলিম ২/৩, হাঃ ২২৬, আহমাদ ৪৯৩, ৫১৩) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৫৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৬১)

তওবার দোয়া

আপনারা চাইলে তওবার নামাজ শেষ করে মোনাজাতের সময় বা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবেন তখন সাইয়েদুল ইস্তেগফার পড়তে পারেন। সাইয়্যিদুল ইস্তেগফারের বিভিন্ন ফজিলত রয়েছে, সুতরাং সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার বা তওবার দোয়া নিচে দেওয়া হল –

اَللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّىْ لآ إِلهَ إلاَّ أَنْتَ خَلَقْتَنِىْ وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّمَا صَنَعْتُ، أبُوْءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَىَّ وَأَبُوْءُ بِذَنْبِىْ فَاغْفِرْلِىْ، فَإِنَّهُ لاَيَغْفِرُ الذُّنُوْبَ إِلاَّ أَنْتَ

সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার সম্পর্কিত হাদিসের সারমর্ম:- কোন ব্যক্তি যদি উপরোক্ত ইস্তেগফারটি (সাইয়্যিদুল ইস্তেগফার) বিষয়বস্তুর উপর পূর্ণ একীন রেখে সকালে পড়বে এবং সে যদি সন্ধ্যার পূর্বে মারা যায় তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি বিষয়বস্তুর ওপর পূর্ণ একীন রেখে সন্ধ্যার সময় পড়বে আর সে যদি সকাল হওয়ার আগে মারা যায় তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *