শরীয়তের পরিভাষায় পানি প্রকারভেদ ও বিধান
শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থায় পানি বা মাটি ব্যবহার করার দ্বারা যে পবিত্রতা অর্জিত হয় তাকে “তহারাত” বলে। তহারাত হাসিলের পদ্ধতিগুলো হল অযু, গোসল, তায়াম্মুম।
পানি
শরীয়তের পরিভাষায় পানি তিন প্রকার:
- সাধারণ পানি
- নাপাক পানি
- ব্যবহৃত পানি
সাধারণ পানি ও তার বিধান
সাধারণ পানি বলতে এমন পানি বোঝায়, যার বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ স্বাভাবিক রয়েছে। যেমন, সমুদ্রের পানি, নদী-নালার পানি, ঝরনা, কুঁয়া ও বৃষ্টির পানি। এই পানি পবিত্র এবং পবিত্রকারী। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ یُنَزِّلُ عَلَیۡکُمۡ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً لِّیُطَهِّرَکُمۡ بِهٖ
এবং আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্য আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছেন যাতে এর মাধ্যমে তোমাদেরকে পবিত্র করেন। (সূরা আনফাল: ১১)
وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا
এবং আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছি যার দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা হয়। (সূরা ফুরকান: ৪৮)
হাদীস শরীফে এসেছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সমুদ্রের পানি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তখন তিনি ইরশাদ করেন-
هُوَ الطَّهُورُ مَاءہ
‘সমুদ্রের পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায়’। (জামে তিরমিযী: ১/১১)
নাপাক পানি
নাপাক বস্তুর মিশ্রণের কারণে পানির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ বর্ণ, গন্ধ কিংবা স্বাদ পরিবর্তিত হয়ে গেলে সে পানি নাপাক। এ বিষয়ে উম্মাহর আলিমগণের ইজমা রয়েছে। আল্লামা শাওকানী লেখেন-
الْإِجْمَاعُ عَلَى أَنَّ الْمُتَغَيِّرَ بِالنَّجَاسَةِ رِيحًا أَو لَونَا أَوْ طَعْمًا نَجِسٌ
নাপাকী মিশ্রিত হওয়ার কারণে যে পানির বর্ণ কিংবা গন্ধ কিংবা স্বাদ পরিবর্তিত হয়েছে তা নাপাক হওয়ার বিষয়ে উম্মাহর ইজমা রয়েছে। (নায়লুল আওতার: ১/৩৫)
এই মাসআলা বেশি পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন নদী, ঝিল, কিংবা বড় হাউযের পানি। নাপাকীর সংমিশ্রণে উপরোক্ত তিন বৈশিষ্ট্যের কোনো একটি পরিবর্তিত হলে এই পানি নাপাক বলে গণ্য হয়। কিন্তু স্বল্প পানি যথা বালতি, কলস ইত্যাদিতে সংরক্ষিত পানি নাপাক হওয়ার জন্য এটা শর্ত নয়; বরং সামান্য নাপাকী মিশ্রিত হলেই তা নাপাক হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-
إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا اسْتَيْقَظَ أَحَدُكُمْ مِنْ نَوْمِه فَلَا يَغْمِسَنَ يَدَهُ فِي الْإِنَاءِ حَتَّى يَغْسِلَهَا فَإِنَّهُ لَا يَدْرِي اينَ بَاتتْ يَدُهُ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হও তখন পাত্রে হাত দেওয়ার আগে তিনবার হাত ধুয়ে নিবে। কেননা তোমাদের জানা নেই যে, ঘুমন্ত অবস্থায় হাত কোথায় কোথায় স্পর্শ করেছে।’ (সহীহ মুসলিম: ১/১৩৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যখন ঘুম থেকে জাগ্রত হও তখন পাত্রে হাত দেওয়ার আগে তিনবার হাত ধুয়ে নিবে। কেননা তোমাদের জানা নেই যে, ঘুমন্ত অবস্থায় হাত কোথায় কোথায় স্পর্শ করেছে।’ (সহীহ মুসলিম: ১/১৩৬)
এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে, অল্প পানি এতটুকু নাপাকীর দ্বারাই নাপাক হয়ে যায় যা হাতে লেগে থাকতে পারে। আর একথা বলাই বাহুল্য যে, হাতে লেগে থাকা সামান্য নাপাকীতে পানির বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ পরিবর্তিত হয় না।
ব্যবহৃত পানি
যে পানি দ্বারা একবার অযু বা গোসল করা হয়েছে তা হল ‘ব্যবহৃত’ পানি। এ পানি নিজে পাক (যদি তার সাথে কোনো নাপাকী মিশ্রিত না হয়ে থাকে) কিন্তু এর দ্বারা দ্বিতীয়বার পবিত্রতা অর্জন করা যায় না। হযরত আবু মূসা (রা.) বলেন-
دَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِقِدح فِيهِ مَاء فَغَسَلَ يَدَهُ وَوَجَهَهُ فِيهِ وَمَج فِيهِ ثُمَّ قَالَ لَهُمَا؛ اشْرَبَا مِنْهُ وَأَفْرِغا عَلَى وُجُوهِكُمَا وَنُحُورِكُمَا
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পাত্রে পানি আনতে বললেন। এরপর তিনি তাতে হাত ও মুখমণ্ডল ধৌত করলেন এবং তাতে কুলি করলেন। এরপর তাদেরকে [আবু মূসা (রা.) ও বিলাল (রা.)কে] বললেন, ‘এখান থেকে কিছু পানি পান কর এবং অবশিষ্ট পানি চেহারা ও সীনার উপর ঢেলে দাও”।’ (সহীহ বুখারী: ১/৩১-৩২)
إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: لَا يَغْتَسِل أَحَدُكُمْ فِي الْمَاءِ الدَّائِمِ وَهُوَ جُنبٌ، فَقَالُوا: يَا أَبَا هُرَيْرَةَ كَيْفَ يَفْعَلُ؟ قال: يَتَنَاوَلُهُ تَنَاولاً
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন আবদ্ধ পানিতে ফরয গোসল না করে।’ লোকেরা জিজ্ঞাসা করল, হে আবু হুরায়রা! তাহলে কীভাবে গোসল করবে? তিনি উত্তরে বললেন, প্রয়োজন পরিমাণ পানি তুলে নিয়ে আসবে। (সহীহ মুসলিম: ১/১৩৮)
প্রথম হাদীস থেকে জানা গেল যে, ‘ব্যবহৃত’ পানি পাক, তা পান করা যায় এবং শরীরে প্রবাহিত করা যায়। দ্বিতীয় হাদীস থেকে বোঝা গেল যে, ‘ব্যবহৃত’ পানি দ্বিতীয়বার পবিত্রতা অর্জনের উপযুক্ত থাকে না। অতএব এই পানি নিজে পাক, কিন্তু অন্যকে পাক করে না। ইমাম আযম আবু হানীফা (রহ.), হাসান বসরী (রহ.), ইমাম যুহরী (রহ.) এবং অন্যান্য ফকীহ এই মত পোষণ করেন।